বাংলাদেশের উন্নয়ন অনুঃধ্যান: একটি সমীক্ষা

04/03/2013 19:11

উন্নয়ন একটি বহুমাত্রিক ধারণা। মানব সমাজের উৎপত্তি ও বিকাশের সাথে উন্নয়নের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মানব সমাজের বিকাশের প্রাথমিক অবস্থায় আদিম সমাজে পাথরের ঘর্ষণের ফলে উৎপন্ন স্ফুলিঙ্গের প্রকাশটি উন্নয়ন নামক ধারণার সূত্রপাত ঘটিয়েছে। এরপর সুদীর্ঘ পথচলা, যেখানে বিভিন্ন সভ্যতা এই উন্নয়ন নামক ধারনার প্রসার ঘটিয়েছে। গ্রীক-রোমান সভ্যতা, সেন্ট্রাল আমেরিকার মায়া ও ইন্কা সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা, ক্যলিডীয় সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতা, মেসোপটেমীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, মধ্যপ্রাচ্যের সেমিটিক ও এন্টি-সেমিটিক সভ্যতা, দক্ষিণ এশিয়ার সিন্ধু সভ্যতা প্রভৃতি উন্নয়নকে পৃথিবীর দিক দিগন্তে ছড়িয়ে দিয়েছে। আধুনিক ও উত্তরাধুনিক সভ্যতার এই সময়ে তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে উন্নয়নের ছোয়া বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে ও বিশ্বের বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে উন্নয়নের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন নিয়ে একটি কার্যকর মিথস্ক্রিয়া গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ও বিশ্বসভ্যতার একটি অপরিহার্য অংশ। নতুন বিশ্বব্যবস্থার এই সময়ে বাজার অর্থনীতি এবং শিল্পায়নের মাধ্যমে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো দারিদ্র্য দূরীকরণের ও শিল্পোন্নত হওয়ার যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, বাংলাদেশ ও এর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বহুমাত্রিক ধারণা হিসেবে উন্নয়ন বিভিন্ন সেক্টরকে নির্দেশ করে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক, সাংষ্কৃতিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সুসম্পর্ক সবকিছুই এর অন্তর্ভূক্ত। যদিও উন্নয়ন বলতে অনেকেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে নির্দেশ করে। বর্তমানে পৃথিবীতে মানবসম্পদ উন্নয়নের একটি প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়েছে। উন্নয়ন নিয়ে বিভিন্ন ধরণের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক গবেষণা ও রয়েছে। বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোতে বিভিন্ন তত্ত্ব বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চলেছে এবং উন্নয়ন প্রসঙ্গে উন্নত বিশ্ব ও দাতাগোষ্ঠীগুলো বিভিন্ন ফান্ড ও পলিসি প্রদানের সাহায্যে এই দেশগুলোতে তাদের মতামত বজায় রাখছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে যার মাধ্যমে কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মত মাইলফলক স্পর্শ করা সম্ভব। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টি আলোচনা করতে গেলে প্রাথমিকভাবে এদেশের সামগ্রিক আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ নীতির মাধ্যমে শিল্প সেক্টরসহ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেওয়া হয়। সত্তরের দশকের শেষ দিকে বাজার অর্থনীতিতে প্রবেশের মাধ্যমে বেসরকারিকরণ নীতি শক্তিশালী করা হয় এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করে। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি পঞ্চ-বার্ষিকী পরিকল্পনা, দ্বি-বার্ষিক পরিকল্পনা নেয়া হয় এবং পরবর্তীতে পুঁজিবাদী অর্থনীতির আদলে পিআরএসপি, রূপকল্প-২০২১ গ্রহণ করা হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ মুক্তবাজার অর্থনীতির বিভিন্ন ধরনের সুবিধা লাভ করে। বেসরকারীকরণ, শুল্কমুক্ত আমদানী-রপ্তানি, কোটা-সুবিধা প্রভৃতি বাংলাদেশের উন্নয়নের সম্ভাবনার ধার খুলে দিয়েছে।
বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার যে প্রক্রিয়ার অভিযাত্রী, তা এদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন বিশেষত: অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে করতে হবে। প্রথমত: রেমিট্যান্স বৃদ্ধির জন্য জনশক্তিকে প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো প্রয়োজন, বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে তা কিছুটা অনুসরণ করছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ আরো বেশি রেমিটেন্স অর্জন করতে সক্ষম হবে। দ্বিতীয়ত: কৃষি বাংলাদেশের প্রধান সম্পদ, উৎপাদন ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য একটি যুগোপযুগি কৃষিনীতি প্রণয়ন করা যেতে পারে। বিভিন্ন সময়ে উৎপাদনের তুলনায় বিক্রয় কম, যার ফলে উৎপাদনকারী ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তা রোধে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা নেয়া যায়। এবং বিদেশে রপ্তানি করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। তৃতীয়তঃ উন্নত বিশ্ব বলতে শিল্পোন্নত দেশগুলোকেই বোঝায়, শিল্প ছাড়া বর্তমান বিশ্বে উন্নত হওয়া অসম্ভব। শিল্পের প্রসার ও মানরক্ষা, শিল্পের বাজার সম্পসারণ এবং শিল্পসম্পর্কিত সার্বিক সমস্যা দূরীকরণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের শিল্প রয়েছে, গার্মেন্টস শিল্প তার মধ্যে অন্যতম। সম্প্রতি তাজরীন ফ্যাশন্সে অগ্নিকান্ডের ফলে ইউরোপ ও আমেরিকায় জিএসপি সুবিধা বাতিলের একটি প্রবল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পরিবেশবান্ধব শিল্পনীতিও প্রতিস্থাপন করলে বাংলাদেশ বহুধরনের জলবায়ুগত হুমকি থেকে রক্ষা পাবে। সীতাকুন্ডে জাহাজ ভাঙা শিল্পের প্রসারে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যা টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ আসার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করছে। চতুর্থত: বর্তমান বিশ্বের উন্নয়ন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন। এজন্য বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি এর গুরুত্ব উপলদ্বিকল্পে একটি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেছে এবং ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ করার প্রয়াসে কাজ করছেন। প্রশাসন সহ সর্বস্তরে স্বচ্ছতা, দূর্নীতি রোধ ও কাজের গতি বৃদ্ধির জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন প্রয়োজন। বর্তমানে ই-কমার্স, ই-গভার্নেন্স, ই-এডমিনিস্ট্রেশান প্রভৃতির মাধ্যমে উন্নয়ন তরান্নিত হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড অন-লাইনে করপ্রদানে জনগণকে উৎসাহিত করছে। এবং পুরো রাজস্ব বোর্ডকে অটোমেশন পদ্ধতির আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছে। তাছাড়া ‘এক্সেস টু ইনফরমেশন’ প্রকল্পের মাধ্যমে জেলা বিভাগ সহ প্রশাসনিক সমস্ত ইউনিটকে তথ্যের আওতায় নিয়ে আসার কাজ চলছে এবং সম্প্রতি তথ্য অধিকার আইনও পাশ হয়েছে। পঞ্চমত: যোগাযোগ খাতে ও বিদ্যুতের ক্ষেত্রে উন্নয়ন না হলে একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যহত হবে। এক্ষেত্রে প্রকল্পের কাজে দুর্নীতি ও প্রকল্পের কাজে রাজনৈতিক প্রভাব উভয়টিই বর্জনীয়। সম্পতি দুর্নীতির কারণে বিশ্ব ব্যাংক, জাইকা ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রভৃতি পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে বড় ধরনের উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হয়েছে। তাছাড়া  রেন্টাল-কুইক রেন্টাল নিয়ে দুর্নীতির প্রশ্ন উঠেছে ও এর স্থায়ী মুনাফার যৌক্তিকতা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।  বিদ্যুৎ ছাড়া শিল্প সেক্টরের সমগ্র কাজ ব্যহত হয় বিনিয়োগ বাধাগ্রস্থ হয়। মাঝে মাঝে গার্মেন্টস্ শিল্পে এর ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ষষ্ঠত: বিনিয়োগ ছাড়া বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের উন্নয়ন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। সদ্য বিদায়ী এফবিসিসিআই সভাপতি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জিডিপি ৬% রাখতে হলে ৮০০ কোটি ডলার প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রয়োজন’। সেজন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা,  বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ ও সুষ্ঠু বিনিয়োগ নীতি নেয়া দরকার।

বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন উভয়ই জরুরী। টেকসই উন্নয়নের জন্য ও বাজার অর্থনীতির প্রসারের জন্য বেসরকারী নীতিকে কাজে লাগানো সময়ের দাবি। তাছাড়া একটি সুষ্ঠু কৃষি নীতি, শিল্প নীতি, মানব সম্পদ উন্নয়ন নীতি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নীতির উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। উন্নত বিশ্ব, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও দাতাগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধিকল্পে প্রয়োজনে বাংলাদেশ সরকারের লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রভাহ গতিশীল করা প্রয়োজন। শাহবাগ আন্দোলন ও তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুনিয়ে যে রাজনৈতিক অস্তিতিশীলতা তৈরী হয়েছে তা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করতে পারে। বাংলাদেশ সরকার অর্থনীতির বিভিন্ন সেক্টর নিয়ে একটি বাজার ও রপ্তানিমুখী সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে, যার মাধ্যমে দারিদ্র দূরীকরণ, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়া এবং সুশাসন, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা ও অংশীদারিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়।