নারীর ক্ষমতায়ন: রাজনীতি ও আন্দোলন, নারী পুরুষ সম্পর্ক ও রাষ্ট্রব্যবস্থা

05/03/2013 14:57

আর্টিকেলের মূল বিষয়ঃ একটি দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথেই নারী ও পুরুষের মাঝে কেমন সম্পর্ক হবে তা নিহিত থাকে, রাষ্ট্রব্যবস্থাই তার জেন্ডার সম্পর্ককে নির্ধারিত করে, আবার এই রাষ্ট্রব্যবস্থা নির্ধারিত হয় ঐ রাষ্ট্রের উৎপাদন সম্পর্ক দ্বারা, বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় ব্যক্তিমালিকানা ও অসম বন্টন স্বীকৃত আদর্শ, আর তাই এখানে নারীরা নির্যাতিত হবে এটাই স্বাভাবিক। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় ঐ সমস্ত দেশে নারী পুরুষে সমতা বিরাজ করত এবং কোন ধরনের নারী নির্যাতিত হতো না বল্লেই চলে, নারীরা ছিল পূরো স্বাধীন এর কারন ছিল মূলত ঐ সমস্ত দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা তথা উৎপাদন সম্পর্ক। নারী ও পুরুষের মাঝে বিদ্যমান বৈষম্য লোপ করতে হলেও সর্বাগ্রে রাষ্ট্র ব্যবস্থার নতুন রূপ দেওয়া অপরিহার্য।

আলোচ্য আর্টিকেল এ গবেষণা পদ্ধতিঃ ‘নারী পুরুষ সম্পর্ক ও রাষ্ট্রব্যবস্থা’ এই আর্টিকেলটির মূল উদ্দেশ্যই হলো একটি রাষ্ট্রের নারী পুরুষ সমস্পর্ক কেমন হবে এটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা ঠিক করে দেয়। এরকম একটি অধ্যয়নের তথ্যের জন্য মাধ্যমিক উৎসের উপরই নির্ভর করতে হয়। াআর্টিকেলে দেখা যায় যে লেখক মূলত মূল্যায়ন ধর্মী ও বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতিই ব্যবহার করেছেন। পূঁজিবাদী সমাজ এবং সমাজ তান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার উপদাহরণ দিয়ে একটি তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণায় বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতিই গবেষণার জন্য উপযুক্ত। তবে এই বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে আরো বেশী সুস্পষ্টতা কাম্য। যেমন লেখক উদাহরণ হিসেবে কিছু তথ্যকে এনেছেন যার যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায় কারণ এগুলোর তথ্যসূত্র ও উল্লেখনেই। আলোচ্য নিবন্ধে বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতির মাঝেই যদি কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং ঐ দেশ সমূহের নারী ও পুরুষের উপর সম্পর্কের সাথে তা কেমন প্রভাব ফেলছে, এমন পরিসংখ্যান দেয়া যেত তাহলে নিবন্ধটি আরো শক্তিশালী হতো।

আর্টিকেলটির শক্তিশালী দিকঃ রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসকারী নারী ও পুরুষের সম্পর্ক কেমন হবে তা ঐ রাষ্ট্রে নারী পুরুষের চেয়ে বেশী নির্ভর করে স্বয়ং রাষ্ট্রের উপর। রাষ্ট্র নারী পুরুষের সম্পর্ককে কি চোখে দেখে, কিভাবে বিবেচনা করে, তার উপরই জেন্ডারের মাত্রা নির্ধারিত হয়। আমরা জানি, রাষ্ট্র কোন বিমূর্ত বিষয় নয়। রাষ্ট্র পরিচালিত হয় শাসক গোষ্টীর দ্বারা। একটি রাষ্ট্রের জেন্ডার সম্পর্কটি তাই কেমন দাঁড়াবে তা নির্ভর করে শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গির উপর, তাদের দ্বারা গৃহীত নীতিমালার উপর। এই নীতিমালা গ্রহণের অবশ্য পটভূমি থাকে। ব্যক্তি মানুষ, সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি যে সমস্ত নীতি বা গৃহীত পদক্ষেপ অনুমোদন দেয়, শাসকগোষ্ঠী সেই নীতিকেই রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করে। আলোচ্য নিবন্ধে দেখা যায় যে এগুলোর সাথে আধুনিককালে আর একটি ব্যাপার যুক্ত হয়েছে যা খুব শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, লেখকের ভাষায়-‘‘আজকের বিশ্বের ধনী দেশের নারী পুরুষ সম্পর্ক কেবল ওই দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার দ্বারা নির্ধারিত নয়, তার উপর বাইরের একটি আধিপত্যবাদী প্রভাব বলয়গত মাত্রা আছে”। আমরা আমাদের দেশের এর প্রভাব দেখতে পারি। ইস্যু হিসেবে এই বিষয়টি তাই বর্তমান সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।

পাশ্চাত্যের দেশেসমূহের নারী বলতেই আমাদের মানসে যে স্বাধীন নারী চোখ ভাসে লেখক বিভিন্ন উদাহরনের মাধ্যমে তা খন্ডিয়েছেন এবং পূঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার কারনে যে নারীরা আরো বেশী করে ভোগ্য পন্যে পরিণত হচ্ছে তা ও দেখিয়েছেন।
নারী নির্যাতনের পেছনে, নারী অধঃস্তন অবস্থার পেছনে সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানা দায়ী, আর এই ব্যক্তিমালিকানা ধারনার পেছনে আছে রাষ্ট্রের উৎপাদন সম্পর্ক, এটাও তিনি সুন্দর ভাবে উঠিয়ে এনছেন, লেখক তার নিবন্ধে নারী নির্যাতনের বিভিন্ন কারনের সাথে নারীর অধঃস্তন অবস্থার সাথে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সম্পর্ককে তুলে ধরেছেন।
আর্টিকেলটির দূর্বল দিকঃ গবেষণাটির দিকে তাকালে প্রথমেই লক্ষ্য করা যায় যে, লেখক তার গবেষনার ব্যবহৃত ঈড়হপবঢ়ঃ গুলোর কোন রকম উবভরহরঃরড়হ প্রদান করেনি। রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং নারী পুরুষ সম্পর্ক বলতে উনি কি বুঝাতে চান তা স্পষ্ট করে  বলা নেই। বিদ্যমান গবেষনায় লেখকের তাত্ত্বিক আলোচনার প্রায় পুরোটা জুড়েই সমাজতন্ত্রের প্রশংসা আর পুঁজিবাদের সমালোচনায় ভরপুর। কমিউনিজম সম্পর্কে লেখক অতিরিক্ত আবেগপূর্ণ, আর পুঁজিবাদ এবং ব্যক্তি মালিকানার প্রতি দেখা যায় প্রচন্ড আক্রোশ। তার এই মনোভাব রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে নারী পুরুষ সম্পর্কের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার জন্য
অন্তরায়। অন্য অনেক সাধারণ/প্রথাগত রুশ পন্থীদের ন্যায় সে ও যুক্তরাষ্ট্রের ঘোর বিরোধী এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রশংসায় পূর্ণ। যেমন সে আফগানিন্তানের সম্পর্কে বলে- ‘‘কমিউনিষ্ট সরকার ব্যাপক হারে নারী পুরুষ ও সকলকে মুক্ত করে নির্বিশেষে বিদ্যালয়ে পাঠাতে থাকে। শিক্ষিত নারীদের সকল পেশায় নিয়োগ দেয়া হয়” অন্যদিকে আমেরিকা সম্পর্ক তার ধারনা -‘‘সাধারণ মানুষের মুক্তি ও মুখ য্ক্তুরাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী বর্বর শাসকদের ঘোরতর অপছন্দ”। পুজিপতিদের উপর ও তার ক্ষোভ অত্যধিক, ফ্যাশন শো ও সুন্দরী প্রতিযোগীতার বিচারকদের তিনি ‘‘বিশ্বের সেরা লম্পট ও বদমাশ” বলেছেন। এভাবে কোথাও কোথাও প্রাসঙ্গিকহীন ভাবে ধনতন্ত্রের চরম বিরোধীতা এবং সমাজতন্ত্র এর প্রতি প্রবল আকৃষ্টতা তার গবেষণার প্রকৃত উদ্দেশ্য কে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করে।
লেখকের মতে সমাজে ব্যক্তিমালিকানা থেকে সৃষ্ট পুজিবাদী ধারনার বিকাশই নারীর উপর পুরুষের কতৃত্বের প্রধান/একমাত্র কারন, একই সাথে যা নারী নির্যাতনের ও কারন। পিতৃতন্ত্র এবং শক্তি সম্পর্ককে তিনি আমলে নেননি। তার মতে নারী নির্যাতনের পেছনেও অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতাই প্রধান কারন, এরই ধারাবাহিকতায় তিনি নারীর বর্তমান ক্ষমতায়নকে নারী মুক্তির আন্দোলনের ফসল না বলে বলেছেন-‘‘নারী মুক্তির প্রচার কিছুটা বেগবান হবার জন্য নয়, আর্থনৈতিক কারনে পুরুষরা তাদের নারীকে পরিবারিক আয়বৃদ্ধিতে যোগ দিতে ঘরের বাইরে অর্থকরী কাজ নিতে আর আপত্তি না করায় নারী মুক্তির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে”। অর্থাৎ তিনি নারীর অর্থনৈতিক মুক্তিকেই নারী মুক্তি হিসেবে দেখেন এবং নারী মুক্তি আন্দোলনের সফলতাকে গুরুত্ব দেয় নি। নারী মুক্তি প্রসঙ্গে ও তার ধারনা পুরুষ নির্ভর- ‘‘পুরুষের সহায়তা ছাড়া নারী একা তার মুক্তি অর্জন করতে পারবে না” বা ‘‘নারীকে পেছনে ফেলে পুরুষ ও বেশী দূর যেতে পারবে না” এই যুক্তির মানে দাড়ায় পুরুষ ছাড়া নারী মুক্তিই সম্ভব নয়, অন্যদিকে নারী ছাড়াও পুরুষ কিছুদূর যেতে পারবে এরকম ধারনা নারী ও পুরুষ বৈষম্য বিশ্লেষণে কার্যকর নয়।
নারী ও পুরুষের বৈষম্য বিলোপ রাষ্ট্রের কি কি ব্যবস্থা নেয়া উচিত, বা নীতি মালায় কোন ধরনের পরিবর্তন আনা উচিত ইত্যাদির আলোচনার পরিবর্তে লেখক অনেকটা আবেগতাড়িত ভাবে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ও চীনের প্রশংসা করে গিয়েছেন-‘‘রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে সমাজতন্ত্র নারী পুরুষ সম্পর্ককে যথেষ্ট সহজ ও স্বাভাবিক করে তোলে এ নিয়ে সন্দেহ কিংবা দ্বিধা দ্বন্দের প্রকাশ অজ্ঞতার তারই নামান্তর। রুশ বিপ্লবের পরে সোভিয়েত ইউনিয়নে এবং চীনে বিপ্লবের পরে গনচীনে প্রথা পদ্ধতির পরিবর্তনের ফলে নারীর অধঃস্তন অবস্থা রাতারাতি যায় বদলে”। আবার বলেছেন-‘‘সমাজতান্ত্রিক দেশে ধর্র্ষনের ঘটনা ঘটেছে এমন খবর কখনো শোনা যায় নি”। সমাজতান্ত্রিক সমাজে ও যে নারীর অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহনে পর তাকেই আবার গৃহকর্মের কাজ ও করতে হতো এটা তিনি বলেননি। এবং উপরোক্ত তথ্য সমূহের কোন উৎস ও উল্লেখ করেননি যা থেকে এর সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ থেকে যায় । একই সাথে তিনি উন্নত দেশ সমূহের অর্থাৎ ভোগবাদী সমাজের নারী পুরুষ সম্পর্ক যৌন স্বেচ্ছাচার হিসেবে উল্লেখ করেন যা সবসময় ঠিক নয়।

বাস্তবতা এবং আর্টিকেল এ প্রাপ্ত জ্ঞানঃ
এই আর্টিকেল থেকে আমরা যে সমস্ত জ্ঞান তৈরী হতে দেখি তা হলো রাষ্ট্রব্যবস্থাই নারী ও পুরষের মাঝে সম্পর্ক ঠিক করে দেয়, আর রাষ্ট্র্রব্যবস্থা নির্ধারিত হয় রাষ্ট্রের উৎপাদন সম্পর্ক দ্বারা।
ক্স    পুঁজিবাদী সমজব্যবস্থায় নারীরা পুরুষদ্বারা নির্যাতিত এবং রাষ্ট্রদ্বারা শোষিত হয় আর অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা নারী পুরুষ বৈষম্য তথা নারী নির্যাতন নেই।
ক্স    নারী মুক্তির জন্য পুরুষের সহায়তা আবশ্যিক কিন্তু পুরুষের এগিয়ে চলার জন্য নারীরা এ তুলানায় কম আবশ্যিক।
ক্স    নারী নির্যাতনের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক কারনই মূল কারন,  অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারনেই পুরুষ যৌতুক নেয়।
ক্স    নারী পুরুষ সম্পর্ক সমতা ভিত্তিক হতে হলে রাষ্ট্রব্যবস্থাটিকে নতুন রূপ দেয়া অপরিহার্য অন্য কোন অবস্থায় এই সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়।
বাস্তবতার নিরীখে দেখা যায় যে রাষ্ট্রব্যবস্থা সত্যিই একটি রাষ্ট্রের নারী ও পুরুষের সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রিত করে। কিন্তু পুুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় যে সবসময় নারীরা নির্যাতিত হয় তা সঠিক নয় কারন আমরা সুইডেন, নরওয়ের দিকে তাকালে এর প্রমাণ পাব, আবার অন্য দিকে সমাজতান্ত্রিক হলেই যে নারীরা কোন রকম পুরুষের কাছ থেকে নির্যাতিত হবে না এই ধারনা ও সঠিক নয়। বাস্তবতায় আমরা দেখি যে অর্থনৈতিক ভাবে স্বচ্ছল পরিাবারেও নারীরা প্রচুর নির্যাতিত হচ্ছে, অর্থাৎ অর্থনৈতিক অবস্থানই নারী নির্যাতনের একমাত্র কারন নয়। বলা যায় যে লেখকের অতিমাত্রায় সমাজতান্ত্রিক মনোভাব তার গবেষনাকে বস্তুনিরপেক্ষ অবস্থান থেকে দূরে রেখেছে।
লেখকের সামাজিক অবস্থান ও আর্টিকেলে এর প্রভাবঃ লেখক পূর্ব পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস এ যোগদানের পর দীর্ঘদিন ফরেন সার্ভিসে কাজ করার পর বর্তমানে অবসরে আছেন এবং প্রগতিশীল কর্মের সাথে যুক্ত এবং তার বই সংখ্যা ৩০টি। নারী মুক্তি আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ততার অভাবের ফলে লেখক নারী পুরুষ বৈষম্যকে একমাত্র সমাজান্ত্রিক ব্যবস্থা দ্বারা নির্মূল হবে বলে ধারনা করেন, যা সঠিক নয়। লেখক সমাজতান্ত্রিক বলয়ের মাঝখানে থেকেই নারী পুরুষ বৈষম্য, নারী নির্যাতন, ইত্যাদির কারন সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন অথচ এই বৈষম্য সম্পর্কে জানতে হলে আরো অনেক গভীরে যেতে হবে।
সবশেষে লেখকের একটি মন্তব্য দিয়ে, বাংলাদেশের নারী সম্পর্কে তার ধারনাকে এবং নারী আন্দোলন সম্পর্কে তার ধারনাকে বুঝানো যেত পারে-‘‘বিশ্বের প্রায় সকল দেশের মতো বাংলাদেশের নারীরা পুরুষ দ্বারা নির্যাতিত বলে অনেকের ধারনা। এদের বিশ্বাস পুরুষ নারীকে তাদের অধীন ও খেলার পুতুল করে রেখেছে, পুরুষকে শায়েস্তা করতে পারলেই নারীর অবস্থার উন্নতি হবে”। আসলে দেখা যায় যে বাংলাদেশের নারীদের এরকম কোন ভাবনা নেই যে পুরুষকে শায়েস্তা করার বরং নারী ও পুরুষের মাঝে বৈষম্যহীন একটি সমাজের স্বপ্নই বাংলাদেশের নারীরা দেখে।