বাংলা সংস্কৃতিতে ভাষা ও ভাষার গান

10/02/2013 16:33

সংস্কৃতি হলো একটি জাতির জীবন বা প্রাণ; যার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠে সে জাতির সভ্যতা, কৃষ্টি ও মনন। যা তার অস্তিত্বের পরিচায়ক। বাঙালী জাতি তার অস্তিত্বের প্রশ্নে যুগ যুগ ধরে তার সংস্কৃতিকে প্রাণ সত্ত্বার মত আগলে রেখেছে। যতবারই তার সংস্কৃতির উপর আগাত এসেছে ততবারই সে স্বমহিমায় গর্জে উঠেছে। নিজের বুককে করেছে ঝাঝড়া বুলেটের আঘাতে। রক্তে রঞ্জিত করেছে রাজপথ।

সংস্কৃতি যদি হয় একটি জাতির প্রাণ তবে ভাষা হলো তার প্রানস্পন্দন। সংস্কৃতির প্রধান ধারক ও বাহক হচ্ছে ভাষা। যার মধ্য দিয়েই সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করে। বাংলা ভাষাকে ঘিরে বাঙালীর আবেগ শতধারায় উৎসারিত হয়েছে। অসংখ্য কবিতা ও গান রচিত হয়েছে বাংলা ভাষায়। সেই আবেগেরই প্রকাশ ঘটেছে ঈশ্বেরচন্দ্র গুপ্তের ‘মাতৃভাষা’, মাইকেল মধুসূদন দত্তের বঙ্গভাষা ও কবি মাতৃভাষা কবিতায়, যা ছিল বাঙালির ভাষাপ্রীতিরই প্রকাশ।

সেই ভাষাতে সুরের মিশ্রণ ঘটিয়ে তৈরী করা হয়েছে গান যা তাকে আরোও প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। বাংলা ভাষাকে প্রধান্য দিয়ে সর্বপ্রথম গান রচনা করেন রামনিধি গুপ্ত ওরফে নিধুবাবু। তিনি লিখলেন,
“না না ন্ দেশের নানান ভাষা
বিনে স্বদেশীয় ভাষা পুরে কি আশা।”
একেই বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক প্রথম গান বলে আখ্যায়িত করা হয়। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে বাংলা ভাষা-ভাষীদের প্রেরণা যুগিয়ে গান লিখলেন অতুলপ্রসাদ সেন-
“মোদের গরব মোদের আশা
আ-মরি বাংলা ভাষা”॥
যার প্রেরণা ছিল দেশপ্রেম, স্বদেশচেতনা ও ভাষাপ্রীতি। পূর্বেই বলেছি যখনই সংস্কৃতির উপর আঘাত এসেছে; বাঙালী জাতি তা শক্তহাতে প্রতিহত করেছে। তারই প্রকাশ আমরা দেখতে পাই বায়ান্ন এর ভাষা আন্দোলনে। যারই ফলশ্রুতিতে রচিত হলো কালজয়ী কিছু গান। আব্দুল লতিফের কথা ও সুরে ও আমার এই বাংলা ভাষা
“এ আমার দুখ ভোলানো বুক জুড়ানো
লক্ষ মনের লক্ষ আশা”॥
আলতাফ মাহমুদের সুরে ও আবদুল গাফফার চৌধুরীর কথায়-
“আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি” ॥

ভাষা আন্দোলনের প্রথম গান হিসেবে রচিত হলো এ গানটিÑ
‘ভুলব না, ভুলব না এ একুশে ফেব্রুয়ারী ভুলব না’
ভাষা আন্দোলনকে প্রাধান্য দিয়ে রচিত হলো ওরা আমার মুখের কথা (ভাষা) বাইড়া নিতে চায়, আমি বাংলা ভাষার এক তারাতে প্রান হারাতে চাই, ভাষার জন্য যারা দিয়ে গেছে প্রাণ ইত্যাদি কালজয়ী কিছু গান। যতদিন বাঙালী জাতি টিকে থাকবে ততদিন এই গানগুলোও বেঁচে থাকবে বাঙালির হৃদয়ে। বাঙালির প্রতিবাদের, প্রতিরোধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এ গানগুলো যা মানুষকে আরোও উজ্জীবিত করেছে তার আপন স্বত্তা তথা আপন সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে।

বর্তমানে আমাদের সংস্কৃতিকে প্রাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব যে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তার অন্যতম প্রকাশ ঘটছে বাংলা ভাষায়। বাংলার সাথে ইংরেজির মিশেলে এক অদ্ভুত ভাষায় ব্যবহার দেখা যাচ্ছে বর্তমান তরুণ সমাজের মধ্যে। যার প্রভাব পড়ছে বাংলা গানে। গানের ঢঙ্গ ও উচ্চারণের ক্ষেত্রে তার প্রভাব সবচেয়ে বেশী লক্ষণীয়। তবে আশার কথা হচ্ছে এর মধ্যেও এক শ্রেণির তরুণ সমাজ এখনোও আছে যারা বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহারের জন্য কাজ করে যাচ্ছে এবং বাংলা গানের সুরে ও বানীতে তার স্বাতন্ত্র্যটুকু বজায় রাখার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। যারা বিশ্বাস করে নিজের সংষ্কৃতিকে ভুলে কখনো পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়া যায় না এবং একটা জাতিকে টিকিয়ে রাখা যায়না জাতি হিসেবে আমরা গর্বিত কারণ পৃথিবীর ইতিহাসে শুধুমাত্র বাঙালী জাতিই ভাষার প্রশ্নে জীবন বাজি রেখেছে। সেই গর্বিত জাতির ভবিষ্যত কর্ণধার হিসেবে আমরাই ভাষাকে রক্ষা করব সকল প্রকার বিকৃতি থেকে।

সুষ্মিতা পাল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Download Full