রাষ্ট্র ধর্ম বনাম নিরপেক্ষতা

13/02/2013 12:50
বাংলায় যাকে আমরা ধর্ম বলি, তাকে ইংরেজীতে তর্জমা করলে দাড়াঁয় রিলিজিয়ন। অথচ ধর্মের অর্থ সব ক্ষেত্রেই রিলিজিয়ন নয়। হাসিম শেখ আর স্বপ্ন বাবুর ধর্ম ভিন্ন-একজন মুসলিম ও অন্যজন হিন্দু। কিন্তু  দুজনই কৃষক। আর কৃষকের ধর্মই চাষ করা। অর্থাৎ ব্যাক্তিগত সমষ্টিগত ধর্মীয় বিশ্বাসের বাইরে গিয়ে ধর্মকে যাপনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত করা যায়। আবার জড়বস্তুরও ধর্ম হয়-প্রাপার্টি। একদল মানুষের ধমীয় বিশ্বাস মৌলবাদে।তাদের সামলাতে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ধর্ম কী হয় তা সম্প্রতি আমাদের দেখার সুযোগ হল।
ধর্ম কী?
ধর্মের শাব্দিক অর্থঃ
          সংস্কৃতির ‘ধৃ’ ধাতুর সাথে ‘মন’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ধর্ম শব্দের উৎপত্তি। ‘ধৃ’ ধাতুর অর্থ ধারণ করা। তাই ধর্ম বলতে বোঝায় যা কোন কিছুর অস্তিত্বকে ধারণ করে থাকে। ইংরেজি Religion শব্দটি সংস্কৃত ও বাংলা শব্দ ধর্ম এর অনেকটা সমার্থক। ইংরেজীতে Religion শব্দের সংজ্ঞায় বলা হয় belief is a higher unseen controlling power especially in a personal God. অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক শক্তির বিশেষত ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস।
ধর্মের পারিভাষিক অর্থ:
ধর্মতত্ত্ব বিদদের নিকট ধর্ম সম্পর্কে বিভিন্ন রকম ও পরস্পর বিরোধী মতামত পরিলক্ষিত হয়। ফলে ধর্মের মৌলিক পরিচয় প্রকাশের চেষ্টা অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। বিভিন্ন মনীষী বিভিন্নভাবে ধর্মের সংজ্ঞা নিরুপণের চেষ্টা করেছেন। জন মোরলে বলেছেন, কথিত আছে ধর্মের দশ হাজার রকম সংজ্ঞা আছে। ধর্মের সংজ্ঞার এ সংখ্যাধিক্য প্রমাণ করে খোদ নৃতাত্ত্বিক গবেষকগণ ও ধর্ম সম্পর্কে এখন পর্যণÍ সুস্পষ্ট ধারণা অর্জন ও প্রদানে ব্যর্থ হয়েছেন।
ধর্মতাত্ত্বিকের পক্ষ তেকে ধর্ম ও রিলিজিয়নের সংজ্ঞা:
হিন্দু পন্ডিতদের মতে:
মহর্ষি পতজ্ঞলী যোগদর্শনে ধর্মের সংজ্ঞায় বলেন, যোগ্যতাবচ্ছিন্না ধর্মিনঃ শক্তিরেব ধর্ম যোগ্যতাবিশিষ্ট ধর্মীর বা পদার্থের কার্যসাধিকা শক্তিই ধর্ম। এ সংজ্ঞাটি তাৎপযপূর্ণ কেননা ধর্ম শব্দের ধাতুগত অর্থের সঙ্গে এর যথেষ্ঠ সামঞ্জস্যতা আছে। যা ধারণ করে তাই ধর্ম। কে ধারণা করে? শক্তি ধারণ করে। বিশ্বজগতে প্রত্যেক পদার্থের অস্তিত্ব রক্ষা করে তার অন্তনির্হিত শক্তি।
পাশ্চাত্য পন্ডিতদের মতে:
নৃ বিজ্ঞানী E.B. Tylor এর মতে, Religion  হচ্ছে, “আত্মিক জীবে বিশ্বাস।”
ফরাসী নৃবিজ্ঞানী ঊসরষব উঁৎশযবরস এর মতে Religion  হচ্ছে “পবিত্র বস্তু ও সম্পর্কিত কতগুলো বিশ্বাস ও প্রথার সমষ্টি।”
Emile Durkheim বলেছেন, Religion  হচ্ছে-“একটা আনুমানিক ধারণা যা এই বিশ্বজগতকে বুদ্ধিগম্য করে তোলে।”
Hegel এর মতে Religion  হচ্ছে জীবাত্মার পরমাত্মারূপে নিজ স্বরূপের জ্ঞান।”
ধর্মের উৎপত্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন মতবাদ সমূহ (যেমন: প্রাকৃতিক মতবাদ, বুদ্দিবৃত্তিক মতবাদ, আধ্যাত্মিক মতবাদ, ররাজনৈতিক মতাবদ) এবং বিভিন্ন পন্ডিদের সংজ্ঞা পর্যালোচনা করলে বলা যায় যে, ধর্ম হল মানুষের পক্ষে কোনো উচ্চতর অদৃশ্য শক্তিকে স্বীকার করে নেওয়া, যে শক্তি মানুষের অদৃষ্টাকে নিয়ন্ত্রণ করে যা মানুষের আনুগত্য শ্রদ্ধা ও পূজাঁ পাওয়ার যোগ্য। অনুরূপভাবে বলা যায় ধর্ম হলো কোনো অতিপ্রকৃত সত্তায় বিশ্বাস, যে বিশ্বাস মানুষের জীবনের সব মূল অনুভূতি এবং ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে।
রাষ্ট্রধর্মঃ
সপ্তম শতকে ফ্রান্সের পোপ কতৃক রাজাকে মুকুট পরানোর মাধ্যমে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয় যে পোপ রাজা ও রাজ্যর উর্ধ্বে। ঠিক এভাবেই মধ্যযুগে রাজা ও রাষ্ট্রের উপর ধর্মের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। মধ্যযুগে ধর্ম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করার মধ্য দিয়ে অন্ধকার যুগের সূচনা পরিলক্ষিত হয়। কারণ ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায় মধ্যযুগ জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিলপ কর্ম তথা সৃজনশীল কোন কিছুই দিতে পারে নি জাতিকে।
মধ্যযুগের ধর্মের মোহভঙ্গের মধ্য দিয়ে রেনেসাঁ যুগের সূচনা হয় যেখানে মানব জাতি প্রবেশ করল অতিপ্রকৃত বিশ্বাস থেকে মানবিয় বিশ্বাসে। উনবিংশ শতাব্দিতে পন্ডিতের ধারণ হয়েছিল যে রেনেঁসার প্রভাবে একবিংশ শতাব্দিতে ধর্মের প্রভাব বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তু বতর্মানে তার বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে ধর্ম অনেক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করছে।
ধর্মনিরপেক্ষতাঃ
ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করলে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন ধর্মকে প্রাধান্য না দেওয়াটাই হচ্ছে প্রাথমিক শর্ত। সে অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মের অনুপস্থিতি। ধর্ম নিপেক্ষ রাষ্ট্র কোনভাবেই একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে না। আবার অনেকে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে সকল ধর্মকে রাষ্ট্র কতৃক সমান ভাবে বিবেচনা করাকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে কোন একটি রাষ্ট্রের পক্ষে কি আদো সকল ধর্মকে সমানভাবে বিচেনা করা সম্ভব?
রাষ্ট্র ধর্ম ও ধর্ম নিরপেক্ষতাঃ
বিশ্বায়ানের এই যুগে অর্থনৈতিক ও জ্ঞান, বিজ্ঞানের প্রচার প্রসারের ফলে সারা পৃথিবী একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে মানুষে মানুষে সম্পর্ক দিন দিন ঘনিভূত হচ্ছে। ফলে একটি দেশে বিভিন্ন দর্মের মানুষের বসবাস একটি সাধারণ ঘটনা পরিণত হয়েছে।
একটি বহুধর্মের দেশে রাষ্ট্র কর্তৃক একটি ধর্মকে স্বীকৃত দেওয়া কতটুকু সংগত? রাষ্ট্র যদি মানুষের কল্যাণের জন্য মানুষ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠান হয়, তাহলে সে রাষ্ট্রে সকল নাগরিক সমানভাবে বসবাস এবং সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারবে।
অপর দিকে যে সকল দেশে একধর্ম। সে সকল দেশে সেই ধর্মটিকেই রাষ্ট্র ধর্ম করার ক্ষেত্রে আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু আপত্তির বিষয় হলো ধর্মের মধ্যে বিবিন্ন দরণের বিভাগের মধ্যে।
নি¤েœাক্ত কারণ সমূহ এ বিষয় টিকে আরও স্পষ্ট করে তুলতে সহায়তা করবে। ধর্ম এবং রাষ্ট্রে, উভয়ই মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু ধর্ম মানুষের ইহকালীন কল্যাণের কথা না বলে পরকালীন কল্যাণের কথা বলে। অপরপক্ষে রাষ্ট্র মানুষের যে সকল কল্যাণের কথা বলে সে সকল কল্যাণ মানুষের ইহকালীন জীবনের। সে ক্ষেত্রে বলা যায় যে মানুষ যে সকল মহান উদ্দেশ্য নিয়ে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করেছে সে সকল উদ্দেশ্য নিয়েই রাষ্ট্র পরিচালিত। পৃথিবীতে অনেক ধর্ম রয়েছে যারা পরকালে বিশ্বাস করে না। তাহলে এক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও ধর্মের অবস্থান হয় বিপরীত।
মানব সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের আচরণ মানবীয়। কিন্তু ধর্ম মানুষের কল্যাণে হলেও তার আচরণ-মানবীয় নয়।
রাষ্ট্র মানুষের প্রতি যে সকল ওয়াদা করেচে তা ইহকালীন সে জন্য রাষ্ট্র পরিচালিত হয় ইহকালীন আইনের মাধ্যমে। কিন্তু ধর্মের ওয়াদা পালন সংক্রান্ত আইন কানুন পরকালীন তাই তা অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ্তাই এক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরই প্রাধান্য পাওয়া যৌক্তিক।
ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গটি সামনে এলে পক্ষ ও বিপক্ষ উভয়ই সংখ্যাগরিষ্টের ধর্মকে সমানে রেখে অস্বাভাবিক স্পর্শকাতর এবং পরিস্থিতির অবতারণা করে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে, ২০০৯ সালের এক হিসাব মতে ১৩টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটির উল্লেখ ও ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু, একটি ধর্মকে শুধু রাষ্ট্র, স্বীকৃতি দিলেই কি তা রাষ্ট্র ধর্ম হয়ে যায়? কারণ ধর্ম রাষ্ট্রের চেয়ে সমাজেই অধিক শক্তিশালী।
উপরোক্ত, আলোচনা থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, ধর্মকে এক কথায় সংজ্ঞায়ন করা সম্ভব নয়। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্ম হীনতা নয়। আর রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ধর্ম নিরপেক্ষতা মনে রাষ্ট্র ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করবে না বা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মের কোন প্রাধান্য থাকবে না।